‘জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী জিয়া-মোশতাক’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক এবং প্রধান সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান। সদ্য স্বাধীন ও নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে অকার্যকর ও ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিদেশি কিছু শক্তির সঙ্গে যোগসাজশে জিয়ার অনুগত সামরিক বাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য এবং অন্যান্য পেশার কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। 

‘সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী ও সুবিধাভোগী কারা?’–এই শিরোনামে রোববার রাতে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন আলোচকরা।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন- তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য সচিব এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ। প্রধান আলোচক ছিলেন আইন মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। আলোচক ছিলেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী সিকদার (অব.), সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। 

স্বাগত বক্তব্যে ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘ইতিহাসের একটা দাবি থাকে, একটা প্রায়োরিটির বিষয় থাকে, জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের প্রচলিত আইনে খুনীদের বিচার হয়েছে। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেককেই বিচারের আওতায় আনা যায়নি। তবে আজ ইতিহাসের দাবি অনুযায়ী সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী কারা, মূল বেনিফিশিয়ারি কারা- এই বিষয়গুলো উম্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এই ব্যক্তিগুলো কারা।’

প্রধান আলোচক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের আগে মেজর জিয়া বলে কাউকে বাংলাদেশের কেউ চিনতো না।  জিয়াউর রহমান যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, তার প্রমাণ হলো, তার দল দ্বারা ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃতি এবং রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানানো। খুনী জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ বন্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে এ বিচারকার্য শুরু করেন।’ 

এই হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম প্রতিটি পদে পদে কিভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল তিনি সেই বর্ণনা দেন। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি সরকার খুনীদের আশ্বস্ত করেছিল, তারা আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে এই মামলা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেবে, খুনীদের কিছু হবে না। জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় না আসতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হতো না।’

বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ”খুনী জিয়াউর রহমান পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের ‘প্রবলেম অব ডেভেলপমেন্ট’ বইটি আমি পড়েছি। ওই বইয়ে তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে মেজর জিয়ার সরাসরি যোগসূত্র ছিল। কয়েক মাস আগে, খুনী ক্যাপ্টেন মাজেদকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে, সে একটি বিবৃতি দিয়েছিল, যেখানে সে একাধিকবার বলেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল চাবিকাঠি নেড়েছিল জিয়াউর রহমান। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে, যে ডিক্লারেশন দেওয়া হয়, সাক্ষ্য আইনের ভাষায় তাকে ডায়িং ডিক্লারেশন বলে। সাক্ষ্য আইনে এর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। কারণ যে জানে কয়েক ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হবে, সে সাধারণত মিথ্যা কথা বলে না।”

ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি বলেন, ‘৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলার মাটিতে ফিরে আসলেন, আমার মনে হয় তখন থেকেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছে তারা বাংলাদেশের গৌরবগাঁথা, গৌরবের ইতিহাস মেনে নিতে পারেনি। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর জাস্টিস সায়েমকে সরিয়ে  মোশতাকের পরে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা নিলেন। জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে, সে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পরিচালিত করেছে। তার নির্দেশে, তার পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একদিন, দুইদিন, ছয়মাস, নয় মাসের পরিকল্পনা ছিল না, এটা ছিল দীর্ঘ পরিকল্পনা, এর রয়েছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। ১৯৭৫ সালের প্রথম ভাগে পলিসি অনুযায়ী উপ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান, কর্নেল রশীদ ও ফারুককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ইউনিট আর্টিলারি ইউনিট ও ট্যাঙ্ক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পোস্টিং দিলেন; যে দুটি ইউনিট ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েকদিন পর ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান। সেনাপ্রধান হওয়ার পরপরই তিনি কর্নেল রশীদ এবং ফারুককে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দেন।’

সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত বলেন, ‘৭৫ সালের পর দেশে একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ছিল। ক্ষমতার প্রতি জিয়াউর রহমানের প্রচণ্ড লোভ ছিল। রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে জিয়াউর রহমান দেশে ফিরিয়ে এনেছিল আর খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণআদালতের রায়কে অস্বীকার করে, বিচার বিভাগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিল।’

ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ এবং জাতির পিতার লালন করা সোনার বাংলার স্বপ্নকে হত্যা করা। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পরাজিত হয়েছিল। এই পরাজয় তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই সিআইএ ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মূলত দেশিয়,আন্তর্জাতিক ও সুবিধাভোগীদের সমন্বিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়।’ 

সভাপতির বক্তব্যে ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘শুধু কয়েকজন বিপথগামী সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী- এটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয়। বাংলাদেশের চেতনাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য একটা বিরাট ষড়যন্ত্র এবং বড় শক্তির প্রত্যক্ষ মদদ ছিল।’

 আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য শবনম আজিম।