কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়ায় সাংসদ ও রাজনীতিবিদদের মর্যাদা সুরক্ষিত হয়েছে

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলায় জেলায় সমন্বয়কারী হিসেবে সচিবদের দায়িত্ব দেয়ার কারণে কেও কেও এটিকে বিরাজনীতিকরণ কিংবা সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাতন্ত্রকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার মতো ঘটনা হিসেবে দেখছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়নি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে ও বাস্তবতার নিরিখে এই বিষয়ে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটিই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, সুশাসন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সংবিধান ও আইন অনুযায়ী সরকার বা নির্বাহী বিভাগের নির্দেশে কাজ করে থাকে। তাদের আলাদা কোন সত্ত্বা নেই। রাজনৈতিক সরকারের নীতি, আদর্শ ও আদেশ বাস্তবায়নই তাদের কাজ। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা, চিকিৎসা ও টিকা কার্যক্রম পরিচালনাসহ এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রান সহায়তাসহ বিভিন্ন অনুদান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া ও সুষ্ঠুভাবে বিতরণের লক্ষ্যে জেলায় জেলায় সার্বিক সমন্বয়ের লক্ষ্যে সচিবদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নানা কারণে বাস্তবসম্মত এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই ব্যবস্থায় সংসদ ও রাজনীতিবিদদের মর্যাদা সুরক্ষিত হয়েছে।

প্রথমত, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের সাথে এই ধরণের কাজ করতে পারে। মহামারিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা কার্যক্রম সমন্বয় ও ত্রান বিতরণসহ মাঠ প্রশাসনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সার্বিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি বলছি, পৃথিবীর অধিকাংশ রাজনীতিবিদেরই এই ধরণের কাজের পেশাদারিত্ব ও প্রশিক্ষণ থাকে না। এটিই স্বাভাবিক; এখানে রাজনীতিবিদদের ছোট হওয়ার কিছু নেই। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজনৈতিক সরকারের কর্মচারী হিসেবেই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। তাঁরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক নন। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষই নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় থাকে। একটি দোকানের মালিক যে কারণে দক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে দোকান পরিচালনার স্বার্থে নিজে কিংবা নিজের ছেলে-মেয়েকে দিয়ে তার দোকান পরিচালনার পরিবর্তে পেশাদার কর্মচারীর মাধ্যমে দোকান পরিচালনা করে, ঠিক একই কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কর্মচারীদের মাধ্যমেই সরকার তার নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সরকার বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায়  চিকিৎসাসেবা সহ ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তার কর্মচারীদেরকে দায়িত্ব দেয়। কর্মচারীদের এই ধরণের কার্যক্রমের প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা থাকে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে তাঁরা এই কাজটি করেন। সরকারি কর্মচারীরা ত্রাণ বিতরণ বা বিতরণের কাজ সমন্বয় করলেই মানুষ এটি মনে করে না যে, এই ত্রাণ তারাই দিচ্ছে। মানুষ এটি ভালোভাবেই জানে যে, এই ত্রাণ-সহায়তা শেখ হাসিনার সরকার দিচ্ছে। আর সরকারি কর্মচারীদেরও প্রতিটি পদক্ষেপে পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তাদের যেকোনো ভূল পদক্ষেপ আর সমন্বয়হীনতার জন্য জনস্বার্থ বিপন্ন হতে পারে, এমনকি জীবনও বিপন্ন হতে পারে। আবার তাদের কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব সরকারের কাধেই আসে। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, সংসদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সব দেশেই সংসদ সদস্যের পদমর্যাদা সচিবদের উপরে। সংসদ রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের একটি বিভাগ। সচিবদের জেলায় জেলায় দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে তাদের পদমর্যাদা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। সংবিধানের স্পিরিট অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ জেলা পর্যায়ে কিংবা অন্যান্য স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণ সহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন না। কারণ এই ধরণের কাজ মূলত নির্বাহী বিভাগের কাজ। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণের কাজ এগুলো নয়। সংসদ সদস্যগণ এই ধরণের কাজে যুক্ত থাকলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব (conflict of interest) সৃষ্টি হতে পারে। কারণ সরকারের সকল কার্যক্রমের জন্য তাকে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। ত্রাণ বিতরণসহ এই ধরণের স্থানীয় কার্যক্রমের সাথে সংসদ সদস্যগণ যুক্ত থাকলে সংসদের কাছে এই জবাবদিহিতার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সংসদ সদস্যগণ দেশের সকল আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করেন। সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে দায়বদ্ধ। তবে জেলায় জেলায় সরকারি কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের উপর সংসদ সদস্যগণ `ওয়াচ ডগের` মতো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। সংসদ সদস্যগণ সময়ে সময়ে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রশাসনকে পরামর্শ সহ দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। 

তৃতীয়ত, একটি জেলায় একাধিক সংসদীয় আসন থাকে। সারা দেশের জেলাগুলোর গড় সংসদীয় আসন সংখ্যা পাঁচের কাছাকাছি। আবার জেলাগুলোতে মন্ত্রীর সংখ্যাও সাধারনত সমান থাকে না। আবার বাস্তবিক কারণে সব জেলায় মন্ত্রী থাকে না। এর ফলে কোন বিবেচনায় কোন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যকে জেলার সমন্বয়কারী নিযুক্ত করা হবে- এটি পরিস্কার নয়। তাছাড়া এক সময়ে এদেশে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত  মন্ত্রীর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সামরিক শাসন পরবর্তী সময়ে তখনকার বাস্তবতায় এই ব্যবস্থা চালু ছিল। এই ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের বিধানাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংবিধান ও অন্যান্য আইনে স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত যে বিধানাবলী রয়েছে, জেলা মন্ত্রীর ব্যবস্থাটি এই বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক।

চতুর্থত, পৃথিবীর সকল দেশেই মহামারি সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা কার্যক্রম সমন্বয় ও ত্রান বিতরণ সহ এসকল কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকে। সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধী অনেক গোষ্ঠী ঘাপটি মেরে থাকে নানা মিথ্যাচার আর গুজব ছড়ানোর জন্য। ফলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই কার্যক্রমের দায়িত্ব দিলে সরকার বিরোধী শক্তিগুলো নানা অপপ্রচার চালানোসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চরিত্রহনন করার সুযোগ পেতো। রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ অপপ্রচারের শিকার হতে পারতো। সরকারি কর্মচারীদের এই দায়িত্ব দেয়ার ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দলীয় নেতৃবৃন্দ এই ধরণের রাজনৈতিক ঝুঁকি থেকে অনেকটা মুক্ত হয়েছে । একশো বছরেরও অধিক সময় পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলকে কিছু কিছু অজনপ্রিয় কাজ থেকে মুক্ত রাখার জন্য ঐ কাজগুলো সরকারের বাইরে পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন  কমিশনকে দেয়া হয়েছিল। এই ব্যবস্থা এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রচলিত রয়েছে।

পঞ্চমত, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় করোনা মহামারী মোকাবেলায় ব্যাপক সাফল্য অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষতা, আন্তরিকতা, নানামুখী বাস্তবিক পদক্ষেপ ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে এবং সর্বোপরি আল্লাহর অশেষ রহমতের কারণে করোনা মহামারী বাংলাদেশে এযাবৎ কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি l জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রবর্তিত এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই এই সাফল্য এসেছে। তাঁর দূরদর্শী ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তের উপর এদেশের সকলেরই আস্থা আছে। দেশের স্বার্থে কোন সময়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, এটি তিনি চমৎকারভাবে বুঝেন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের সকল সেক্টরেই তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছেন।