আব্দুল মতিন খসরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

খবরটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমাদের খুব কাছের মানুষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক আইন মন্ত্রী এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। তাঁর সাথে আমার অনেক স্মৃতি, অনেক ইতিহাস। তিনি ছাত্র জীবনে আমার বাবার খুব স্নেহভাজন ছিলেন। সেই সম্পর্ক থেকেই পরবর্তী জীবনে তাঁর সাথে আমার সখ্যতা হয় । আমি ছাত্র লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক হওয়ার পর থেকে তার সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়।  তিনি আইনমন্ত্রী থাকালীন সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ছিলাম । ঐ সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আইনের একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে প্রায়ই আমার মতামত জানতে চাইতেন। মূলত বিভিন্ন ইস্যুর একাডেমিক ও প্রায়োগিক বিষয় এবং এর পলিটিকাল ইমপ্লিকেশন্স বুঝার জন্যই তিনি প্রায়ই আমার সাথে কথা বলতেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে আব্দুল মতিন খসরু নামটি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে এই জন্য যে, আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী (তখন প্রতিমন্ত্রী) হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী  শেখ হাসিনার নির্দেশে তিনিই সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের বিল উত্থাপন করেছিলেন এবং সংসদে এক ঐতিহাসিক আবেগপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন যা বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে জাতির পিতার হত্যাকারীদের রক্ষাকারী ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করা হয়েছিল। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করার লক্ষ্যে আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি পর্যায়ক্রমে দেশের বেশ কয়েকজন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহন করেছিলেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ আইনের শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে সেই সময়ে তিনি আমারও মতামত নিয়েছিলেন । তার কারণ ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রহিতকারী কালো আইন কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আমিই প্রথম গবেষণা করেছিলাম ১৯৯১ সালে।

আরেকটি কারণে তিনি স্মরণীয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হয়েছিল কুমিল্লার বার্ডে। অন্যতম হত্যাকারী মোশতাক সহ কয়েকজনের বাড়ী ছিল কুমিল্লা।

আর মূল হত্যাকারীদের প্রাসংগিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ কুমিল্লা থেকেই শুরু হয়েছিল। এই সকল কারণে কুমিল্লার মানুষের মধ্যে অনেক বেদনা ও কষ্টবোধ ছিল এবং আজও আছে। কুমিল্লারই একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আব্দুল মতিন খসরুকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের কার্যক্রম পরিচালনা করার। এই কাজটি তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে করতে পেরেছিলেন। কুমিল্লাকে তিনি কিছুটা হলেও দায়মুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে জননেত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লার আরও দুইজন মেধাবী আইনজীবী- ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও অ্যাডভোকেট আনিসুল হক (বৃহত্তর কুমিল্লার) কে আইনমন্ত্রী হিসেবে  দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিচ্ছিতকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় কার্যকরকরনের বিষয়গুলো সমন্বয়ের জন্য। এই তিনজন মেধাবী আইনজীবীই জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পারদর্শিতার সাথে এই মহৎ কাজগুলো করতে পেরেছিলেন। জাতির এই ঐতিহাসিক কাজের জন্য  আরেকজন  ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি হচ্ছেন আইন সচিব জহিরুল হক দুলাল। তিনিও গত বছর কোভিড আক্রান্ত হয়ে আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছেন।

দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সহ সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারক  তাঁর সময়েই সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন। পাঁচ বার সংসদ সদস্য, আইনমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার পরেও তিনি সব সময়ই ছিলেন নিরহংকারী ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী। তিনি সবসময়ই আন্তরিকভাবে  রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতেন । ছোট বড় সবাইকেই তিনি সম্মান করতেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আমরা কয়েকজন দুই সপ্তাহের জন্য চীন সফরে গিয়েছিলাম। মাননীয় নেত্রী জনাব আব্দুল মতিন খসরুকে আমাদের দলনেতা নিযুক্ত করেছিলেন। আমাদের সফরের কয়েকদিন আগে তিনি একটু অসুস্থ্য ছিলেন । আমার এখনও মনে আছে, আমাদের চীনের উদ্দেশে যাত্রার দিন দুপুর বেলা আমরা যখন মাননীয় নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম, মাননীয় নেত্রী আমাদের দলনেতা আব্দুল মতিন খসরুর স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চিন্তিত ছিলেন, জনাব খসরু অসুস্থ্য শরীর নিয়ে ডেলিগেশনকে ঠিক মতো নেতৃত্ব দিতে পারে কিনা। জনাব খসরু অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে চীনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডেলিগেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

জাতির এই কৃতি সন্তান অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু এমপি`র প্রতি জানাচ্ছি আমার গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোক সন্তত্ব পরিবার এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মাননীয় সভাপতি সহ দলের সকল পর্যায়ের নেতা কর্মী, তাঁর  নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লার বুড়িচং-  ব্রাম্মনপাড়ার জনগণ এবং তাঁর সহকর্মী সকল আইনজীবীর প্রতি জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু আজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাঁর অবদান সবসময় মনে রাখবে।